অল্প সময়ে ওজন কমাতে ডায়েটের বিকল্প নেই। প্রয়োজন শুধু একটু ইচ্ছাশক্তি আর সংযম। সঠিক নিয়ম মেনে চললে এক মাসে চার-পাঁচ কেজি ওজন কমানো সম্ভব। প্রথম দিকে ওজন না কমলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কখনো কখনো ডায়েট শুরুর মাসখানেক পর থেকে ওজন কমতে আরম্ভ করে।
লকডাউনে গৃহবন্দি থাকায় অনেকেই শরীরের ওজন লাগামহীনভাবে বেড়ে গিয়েছে। ব্যবসা বা কর্মস্থলে আবার ফিরে যাওয়ায় নিজেকে মানানসেই মনে হচ্ছে না। এই বাড়তি ওজন কমিয়ে ফেলতে পারলে করোনাভাইরাসের জটিলতার আশঙ্ক অনেকাংশে কমবে। যাদের উচ্চ রক্তচাপ, সুগার-কোলেস্টেরল, হার্টের সমস্যা আছে, তারা যদি অতিরিক্ত ওজনের ৫ শতাংশও স্বাস্থ্যকর উপায়ে কমিয়ে ফেলতে পারেন, এ সব রোগের প্রকোপ কমার সঙ্গে সঙ্গে কমবে করোনার জটিলতার আশঙ্কাও৷ এক-দেড় মাসে ৪-৫ কেজি ওজন কমাতে পারলে বজায় থাকবে সবদিক৷ কিন্তু প্রশ্ন হল, ক্র্যাশ ডায়েটিং ছাড়া এত কম দিনে কি ৪-৫ কেজি ওজন কমানো সম্ভব? করোনা আবহে ক্র্যাশ ডায়েটিং তো করা যাবে না৷ বেশি ব্যায়াম করলেও বিপদ৷ দেখা যাক বিশেষজ্ঞেরা কী বলছেন৷
পুষ্টিবিদরা বলছেন, দেড় মাসে ৪-৫ কেজি কমানো এমন কোনও বড় টার্গেট নয়৷ নিয়ম মেনে ডায়েটিং ও একটু হাঁটাচলা বাড়ালে, ঘরের সব কাজ নিজে হাতে করলে খুব ভাল ভাবেই কমানো সম্ভব৷ তার উপর যদি ব্যায়াম করতে পারেন, তা হলে তো কথাই নেই৷ ভাবছেন খিদে পাবে কি না? পাবে না৷ বুঝেশুনে খেলে এখন যা খাচ্ছেন, তার চেয়ে ১০০০ ক্যালোরিও যদি কম খান, খিদে পাবে না৷ ডায়েটিং করতে পারবেন বেশ পেটপুরে খেয়েই।
কম খেয়ে ডায়েটিং করার কথা ভুলে যান৷ কারণ, কম খেলে খিদে পাবে সর্ব ক্ষণ৷ খিদে চেপে রাখলে এক দিকে যেমন মন খাই খাই করবে, তাতে অনেক সময় ভুলভাল খেয়েও নেবেন। অন্যদিকে খিদে পেটে ঘুম আসবে না, মেজাজ খিটখিট করবে, ক্লান্ত লাগবে, অপুষ্টি হবে৷ সবে মিলে ওজন যদিও বা দু-এক কেজি কমেও, চেহারায় পড়বে ক্লান্তির ছাপ। ফিটনেসে ঘাটতি হবে৷ অপুষ্টি ও অনিদ্রার ফলে কমতে পারে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও। যা এই মুহূর্তে খুবই বিপজ্জনক৷ অতএব ও পথে না হেঁটে খাবারে কিছু পরিবর্তন আনুন৷ ভাজা, মিষ্টি ও অন্যান্য হাই ক্যালোরি খাবার ও মিষ্টি পানীয়ের পরিবর্তে খান ফাইবারসমৃদ্ধ পুষ্টিকর ঘরোয়া খাবার৷ খাবারে পর্যাপ্ত ফাইবার থাকলে কম খাবারেই পেট ভরে যাবে ও বেশি ক্ষণ ভরে থাকবে৷ তার সঙ্গে মাপ মতো কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও উপকারি ফ্যাট খেলে তৃপ্তি যেমন হবে, পুষ্টিও হবে তেমন৷ সবে মিলে ওজন কমবে পেটপুরে খেয়েও৷
রাতারাতি খাবারের রুটিন বদলে ফেলার কোনও দরকার নেই৷ এখন যেভাবে যা খাচ্ছেন, তার মধ্যে থেকেই একটু কাটছাট করে নিন৷
ডিম খেতে ভাল লাগলে খাওয়া বন্ধ করার দরকার নেই৷ শুধু কুসুমটা বাদ দিয়ে দিন৷ আগে হয়তো একটা আস্ত ডিম খেতেন, এখন ৩-৪টে ডিমের সাদা অংশও খেতে পারেন৷ সেদ্ধ করে৷
রেডমিট পছন্দ হলে ভাল করে চর্বি কাটছাট করে নিয়ে কম তেলে রান্না করুন৷ সেদ্ধ করা জলটা ফেলে দিলে চর্বি আরও কিছুটা কমবে৷ এভাবে রান্না করা মাংস সপ্তাহে এক দিন দুইটুকরো খেলে ক্ষতি নেই৷
ফল ছাড়া কোনও মিষ্টি খাবার খাবেন না৷ ফলও খুব বেশি খাওয়ার দরকার নেই৷ দিনে একটা বা দুটো গোটা ফল খেতে পারেন৷ তার মধ্যেও যেটা কম মিষ্টি সেটা বেছে নিন৷
কোনও মিষ্টি পানীয় খাবেন না৷ ফলের রসও নয়৷ এসব খেলে পেট তো ভরেই না বরং একসঙ্গে অনেকটা ক্যালোরি ও চিনি শরীরে এসে বাড়িয়ে দেয় ভুঁড়ির আশঙ্কা৷ মাঝেমধ্যে স্মুদি খেতে পারেন৷ ফল দিয়ে রায়তা বানিয়েও খেতে পারেন৷
ভাত পছন্দ হলে কষ্ট করে রুটি খাওয়ার দরকার নেই৷ বরং একমুঠো করে ভাত কমিয়ে সে জায়গায় কম ক্যালোরির সব্জি সিদ্ধ খান৷ যেমন, পটল, ঢেড়শ, করলা, বেগুন ইত্যাদি৷ কম তেলে রান্না করা এক হাতা শাক বা পাঁচমিশালি সব্জিও খেতে পারেন৷ অর্থাৎ ভাত-রুটির পরিমাণ কমিয়ে, দরকার হলে আগের অর্ধেক করে শাক-সব্জি খাওয়া দ্বিগুণ করে দিন৷ এক ধাক্কায় নয়, ধাপে ধাপে করবেন৷ না হলে পেটের গোলমাল হতে পারে৷ হতে পারে অতৃপ্তিও৷ সাদা ভাতের বদলে ব্রাউন রাইস খেতে পারলে বেশি ফাইবার পাবেন, তবে তার স্বাদ ভাল না লাগলে সাদা ভাতই খান৷ সঙ্গে নানা রকম সবজি৷
বেশির ভাগ সবজির খোসা ছাড়াবেন না৷ বেশি ফাইবার পাবেন৷ তাতে কম খাবারেই বেশি ক্ষণ পেট ভরা থাকবে৷ অন্যান্য পুষ্টিও পাবেন বেশি৷
মূল খাবার খাওয়ার আগে মাখন না দেওয়া একবাটি ক্লিয়ার সু্প, সবজি বা চিকেন ব্রথ, ডাল সেদ্ধ বা ড্রেসিং না মেশানো এক প্লেট স্যালাড খেলে কম খাবারেই পেট ভরবে৷
মাছ, মাংস, ডিম আগের চেয়ে একটু কম খেয়ে সে জায়গায় খান ফাইবারসমৃদ্ধ উদ্ভিজ্জ প্রোটিন৷ যেমন, বিন, সয়াবিন, রাজমা, ছোলা, মটর, ডাল৷ উপকার যেমন হবে, পেটও ভরা থাকবে বেশিক্ষণ৷
ময়দাজাত খাবার একেবারে বাদ দিন৷ ন-মাসে ছ-মাসে এক আধবার পরোটা খেতে ইচ্ছে হলে হয় ময়দার মধ্যে সবজির পুর মেশান নয়তো আটা দিয়ে বানান৷ সবচেয়ে ভাল হয় বিভিন্ন ধরনের সবজি মেশানো রুটি খেলে৷
তেল-ঘি-মাখনের উপকার থাকলেও এ সময় যত কম খাওয়া যায় তত ভাল৷ তবে একেবারে বাদ দিয়ে দেবেন না৷ ভিটামিন ডি ও ই-এর শোষণ বাড়াতে একটু তেল-ঘি এর প্রয়োজন আছে৷ এর পাশাপাশি সব রকম বাদাম, বীজ, অ্যাভোক্যাডো, অলিভ অয়েল, তৈলাক্ত মাছ অল্প করে খান৷ এতে ক্যালোরি কিছুটা বাড়লেও উপকার পাবেন প্রচুর৷ পেট বেশিক্ষণ ভরা থাকবে৷ তৃপ্তি হবে বলে খাইখাইভাব থাকবে না৷
বাজারের লো-ফ্যাট খাবার একেবারে খাবেন না৷ তাতে ফ্যাট কম থাকলেও চিনি থাকে প্রচুর৷ তাতে অপকারের পাল্লাই ভারি হয়৷ ওজন কমারও সুরাহা হয় না৷
ফাস্ট ফুড ও প্রসেস করা খাবার খাবেন না৷ কারণ তাতে তেল-ঘি-লবণ-মিষ্টি সবই বেশি থাকে৷
টুকটাক খাওয়ার অভ্যাস বদলাতে হবে৷ দিনে ৫-৬ বার খাবেন৷ সকালে মোটামুটি পেটভরে ব্রেকফাস্ট৷ মাঝসকালে ফল বা ঘোল কি সালাদ৷ দুপুরে ডাল, সালাদ, সবজির সঙ্গে অল্প ভাত বা রুটি ও মাছ/চিকেন/ডিম/দই৷ ডেজার্ট এখন না খাওয়াই ভাল৷ খুব ইচ্ছে হলে অল্প খেজুর খেতে পারেন৷ বিকেলে মুড়ি-বাদাম বা হালকা অন্য কিছু৷ রাতে আবার দুপুরের মতো খেয়ে আধ ঘণ্টা একটু হাঁটাহাটি করে ঘণ্টা দুয়েক পরে ঘুমোতে যাওয়া৷ খেয়াল রাখবেন, দিনের প্রতিটি খাবারে যেন প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ ঠিক থাকে।
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে ওজন কমানোর নতুন একটি পদ্ধতি নিয়ে এসেছেন। তারা বলছেন, দই-কালোজিরার মিশ্রণ নিয়মিত খেলে এক মাসে ১৫ কেজির মতো ওজন কমবে।
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রকাশ করা সমীক্ষা-রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪৪ জন মেদযুক্ত মানুষের ওপর এই মিশ্রণের প্রভাব পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, প্রতিদিন যদি দই-কালোজিরার এই মিশ্রণ খাওয়া যায় তাহলে এক মাসে অন্তত ১৫ কেজি ওজন কমানো সম্ভব।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে একটি পাত্রে এক চা চামচ কালোজিরাগুঁড়ো আর এক গ্লাস পাতলা টক দই ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে রাতে শোওয়ার আগে খেতে হবে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, এই মিশ্রণ শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে কমে যায় মেদের পরিমাণ এবং দ্রুত হ্রাস পায় শরীরের ওজন।
দৈহিক সৌন্দর্যকে অটুট রেখে বাড়তি ওজন কমিয়ে ফেলুন। নিজেকে সুন্দর ও ফিট রাখতে সব সময়ই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।